ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। সবুজের সমারোহ আর প্রাকৃতিক অপরূপ সৌন্দর্য এ ক্যাম্পাসকে দিয়েছে ভিন্ন মাত্রা। সবুজের এ ক্যাম্পাসে যখন লাল বাসের আসা-যাওয়া শুরু হয় তখন ক্যাম্পাস যেন লাল-সবুজে মিশে যায়। কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ রুটে চলে বাসগুলো। প্রতিদিন সকালে শিক্ষার্থীদের বহন করে নিয়ে যায় ক্যাম্পাসে। আবার ক্যাম্পাস থেকে পৌঁছে দেয় যার যার গন্তব্যে। ক্যাম্পাসের লাল বাসগুলো দেখে অনেকে হারিয়ে যান স্মৃতির অ্যালবামে। আবার কেউ কেউ অনুপ্রেরণা পান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হয়ে এই বাসগুলোতে নিজের জন্য একটি আসন দখল করতে।
কুষ্টিয়া কিংবা ঝিনাইদহ শহর থেকে বাস ছাড়ার আগে আগে শিক্ষার্থীরা মোড়ে মোড়ে যখন বাসের জন্য অপেক্ষা করেন, তখন যেন শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছোটখাটো একটা মিলনমেলা হয়ে যায়। আবার ক্যাম্পাস থেকে বাস ছাড়ার আগে আগে অনেকেই গিয়ে ব্যাগ, ছোট বই কিংবা সিটপাতি দিয়ে বাসে সিট ধরে থাকেন। অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী অনিল মো. মোমিন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে লালবাস অন্য রকম এক আবেগ ও ভালোবাসার নাম। এই বাসে তৈরি হয় অনেক গল্প। হয় বন্ধুত্ব-প্রেম। বন্ধুরা মিলে দলবেঁধে আড্ডা, গলা ছেড়ে গান আর নানান খুনসুটিতে জার্নি হয় প্রাণবন্ত। লালবাসে প্রতিটি পদক্ষেপ স্মরণ করিয়ে দেয় আমাদের পরিশ্রম আর সফলতা-সংগ্রামের গল্পও। যেতে যেতে এই বাসে নতুন স্বপ্নরা ডানাও মেলে। সড়কজুড়ে যখন মাথা উঁচু করে সাঁই সাঁই করে ছুটে চলে তখন নিজের ভেতর এক বিশেষ অনুভূতি কাজ করে। দ্বিতল ডাবল ডেকারের ওপর থেকে যেন দেশের প্রতিচ্ছবি দেখি! দেখতে পাই প্রকৃতি, নাগরিক জীবন আর আমাদের গন্তব্য। যেটা আমাদের অনুপ্রাণিত করে ভালো কিছু করার। দেশ, দেশের মানুষ ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার অনুভূতিও জাগিয়ে দেয়।
এ বাসে বসেই অনেকে গিটারে সুর তোলেন। কেউবা গলা ছেড়ে গান ধরেন। অন্যরা সঙ্গে সঙ্গে সুর মেলান। বাদাম মুখে দিয়ে গল্পগুজবে মেতে ওঠেন অনেকে। সারা দিনে ক্লান্ত শরীর নিয়ে মেসে বা বাসায় ফিরতিপথে বাসের সিটেই ঘুমিয়ে যান কেউ কেউ। আবার অনেককে দেখা যায় চাকরি-বাকরির বই নিয়ে সিটে চোখ বুলাতে। বাসের জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে বুক ভরে শ্বাস নেন অনেকে। এ সময় রাস্তার পাশের সবুজখেত মনকে করে প্রশান্ত। তবে মাঝেমধ্যে ধুলোময়লা বাধা হয়ে দাঁড়ায় জানালা খুলে শুদ্ধ বাতাস গ্রহণের ক্ষেত্রে।
এ লাল বাসে প্রতিদিন কতশত স্মৃতি জমা হয়। বন্ধুদের রঙিন মুহূর্তগুলোর সাক্ষী হয়ে ছুটে চলে রঙিন বাসগুলো। শিক্ষা শেষে সবাইকে ক্যাম্পাস ছেড়ে পাড়ি জমাতে হয় নতুন নতুন গন্তব্য। কিন্তু বাসগুলো থেকেই যায় এই সবুজ চত্বরে বহু দিন।
সেমিস্টার পরীক্ষার ভাইভা শেষে ক্যাম্পাসে বিভিন্ন জায়গায় ছবি নেয়ার ধারাবাহিকতায় অনেকে ছুটে যান লাল বাসে। বাসের সামনে, দরজায় কিংবা দোতলায় দাঁড়িয়ে নতুন নতুন পোজে ছবি তোলেন। আসলে, লাল বাসের মায়া ভোলা দায়। রাস্তায় লাল বাসগুলো মানুষের মনে তৈরি করে শিহরণ। শুধু কী শিক্ষার্থী, অনেক অভিভাবকের মনে স্বপ্নের বীজ বুনে দেয় এ লাল বাসগুলো। আমার সন্তানও একদিন এই লাল বাসে করে ক্যাম্পাস যাবে। জ্ঞানের রাজ্যে বিচরণ করবে আমার সন্তান, এমন অনেক স্বপ্ন। সত্যি কথা বলতে হাজারও অনুপ্রেরণার আঁতুড়ঘর এই লাল বাস।
‘আমি ইবিয়ান’ কিংবা ‘আমি গর্বিত ইবিয়ান’ এমন কত কথাই না জায়গা পায় ইবিয়ানদের টি-শার্টে। আর এগুলোর সঙ্গে যদি একটা লাল বাসের ছবি আঁকা থাকে তাহলে তো সোনায় সোহাগা। আসলে এ ক্যাম্পাসের বাসগুলো শিক্ষার্থীদের পরিচয় তুলে ধরে যে, এরা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষার্থী মো. তাজুল ইসলাম বলেন, ইবির লাল বাস শুধু একটি বাস নয়। এটি ভালোবাসা, আবেগ ও সম্প্রীতির প্রতীক। বন্ধুদের সঙ্গে গান-আড্ডায় মেতে ওঠা অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার ঘণ্টা যেন মিনিটে রূপ নেয়। এটি ইবির অসাম্প্রদায়িক চেতনার পরিচায়ক। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে গড়ে তোলে একটি পরিবার।
সমাবর্তন, পুনর্মিলনীতে কিংবা অন্যান্য কারণে প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের আগমন ঘটে ক্যাম্পাসে। এ সময় লাল বাসগুলোই যেন তাদের স্মৃতির দিনগুলো ফিরে পেতে সাঁকো হয়ে সামনে উপস্থিত হয়। এ বাসেই তো চলত তাদের কতশত আড্ডা-গান কিংবা বাদাম খাওয়ার রঙিন মুহূর্তগুলো। লাল বাসের স্মৃতি তাদের আলিঙ্গন করে। লাল বাসের স্মৃতিচারণা করে ফলিত পুষ্টি ও খাদ্য প্রযুক্তি বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগের প্রভাষক বিল্লাল হোসেন বলেন, লাল বাস প্রত্যেকটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে একটি স্বপ্নের নাম, একটি আইকনের নাম। তেমনিভাবে আমাদের ক্যাম্পাসের লাল বাসগুলো আমার কাছে সব সময় আইকনিক মনে হতো। যখন বাসে চড়তাম তখন অসম্ভব রকমের ভালো লাগা কাজ করত। নিজেকে একটু অন্যরকম মনে হতো!
মারুফ হোসেন
দৈনিক বাংলা
প্রকাশিত
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস